মাতৃতান্ত্রিক পরিবার কোন উপজাতি

বাংলাদেশের উপজাতিরা বিভিন্ন জাতিগত গোষ্ঠীর সমন্বয়ে গঠিত। এদের প্রতিটি গোষ্ঠীর নিজস্ব সংস্কৃতি, ভাষা, ধর্ম, এবং ঐতিহ্য রয়েছে। বাংলাদেশের বিশেষ একটি উপজাতির মধ্য একটি হলো মাতৃতান্ত্রিক উপজাতি , এই উপজাতির নিজস্ব সমাজব্যবস্থা, ঐতিহ্যবাহী পোশাক, খাদ্যাভ্যাস, এবং ধর্মীয় বিশ্বাস রয়েছে, যা তাদের আলাদা করে তুলে ধরে। এরা বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে সমৃদ্ধ করে তোলে।

মাতৃতান্ত্রিক উপজাতি হল এমন এক সমাজ ব্যবস্থা যেখানে মহিলারা প্রধান ভূমিকা পালন করেন এবং সমাজের বিভিন্ন দিক পরিচালনা করেন। এই ধরনের সমাজে উত্তরাধিকার, সম্পত্তি, এবং সামাজিক মর্যাদা মহিলাদের মাধ্যমে প্রাপ্ত হয়। পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে এমন অনেক মাতৃতান্ত্রিক সমাজ রয়েছে, যা তাদের স্বতন্ত্র সংস্কৃতি ও প্রথার জন্য পরিচিত। এই প্রবন্ধে আমরা মাতৃতান্ত্রিক সমাজের বৈশিষ্ট্য, উদাহরণ এবং এর প্রভাব নিয়ে আলোচনা করবো।

মাতৃতান্ত্রিক সমাজে মহিলারা পরিবারের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে বিবেচিত হন। তাদের মাধ্যমে পরিবারে সম্পত্তি এবং সম্পদ বিতরণ হয়। এই সমাজ ব্যবস্থায় মহিলারা সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক দিক থেকে উচ্চ মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানে থাকেন। পুরুষরা সাধারণত বাড়ির বাইরের কাজ এবং শিকার বা কৃষিকাজে যুক্ত থাকেন, কিন্তু মহিলারা বাড়ির অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনা এবং সন্তানের লালন-পালন নিয়ে ব্যস্ত থাকেন।

এছাড়াও, মাতৃতান্ত্রিক সমাজে বিবাহ প্রথা, পরিবার গঠন, এবং সন্তান লালন-পালনের ক্ষেত্রে মহিলারা মূল সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী হন। পুরুষরা স্ত্রীর পরিবারে বাস করেন এবং তাদের সন্তানরা মায়ের লাইন দ্বারা পরিচিত হয়। এ ধরনের সমাজে বিবাহ বিচ্ছেদ সহজ এবং সন্তানদের উপর মায়ের প্রভাব বেশী থাকে।

মাতৃতান্ত্রিক সমাজের প্রভাব

মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা মহিলাদের ক্ষমতা এবং মর্যাদাকে উচ্চতর স্থানে নিয়ে যায়। এই ধরনের সমাজে মহিলারা শুধু পরিবারের নয়, সমাজের বিভিন্ন দিক পরিচালনা করে থাকেন। এতে সামাজিক সমতা এবং নারীদের স্বাধীনতা বৃদ্ধি পায়। মাতৃতান্ত্রিক সমাজের এই বৈশিষ্ট্যগুলি সমাজে পুরুষতান্ত্রিক প্রথার বিরুদ্ধে একটি সুস্থ পরিবর্তন নিয়ে আসে। তবে, মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। আধুনিক সমাজে পরিবর্তিত জীবিকা, শিক্ষা এবং প্রযুক্তির প্রভাবের কারণে অনেক মাতৃতান্ত্রিক প্রথা এবং সংস্কৃতি হুমকির মুখে পড়ছে। বিশেষ করে, নগরায়ন এবং আধুনিকীকরণের ফলে অনেক মাতৃতান্ত্রিক সমাজ তাদের ঐতিহ্য হারানোর ঝুঁকিতে রয়েছে।

বাংলাদেশে কয়েকটি উপজাতি সমাজে মাতৃতান্ত্রিক প্রথার অনুসরণ দেখা যায়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য দুটি উপজাতি হল গারো এবং খাসি।  বিশেষ করে, পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের কিছু উপজাতি সমাজে এই প্রথার চর্চা রয়েছে। মাতৃতান্ত্রিক উপজাতির মহিলারা পরিবারের প্রধান এবং পরিবারের সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। সম্পত্তি এবং জমি মায়ের লাইন দ্বারা উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত হয়। মা তার মেয়েদের মাঝে সম্পত্তি বণ্টন করেন। বিবাহের পরে পুরুষরা স্ত্রীর বাড়িতে চলে আসে এবং সেখানে বসবাস করে। এটি ম্যাট্রিলোকাল রেসিডেন্স নামে পরিচিত।

বাংলাদেশের এই মাতৃতান্ত্রিক সমাজগুলিতে মহিলাদের ক্ষমতা এবং মর্যাদা উল্লেখযোগ্যভাবে উচ্চতর। তারা পরিবারে এবং সমাজে প্রধান ভূমিকা পালন করে, যা তাদের স্বতন্ত্র ও শক্তিশালী করে তোলে। তাছাড়া, এই প্রথা সমাজে নারীদের অধিকার এবং সমতা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। বাংলাদেশের গারো এবং খাসি উপজাতি সমাজগুলি মাতৃতান্ত্রিক প্রথা অনুসরণ করে, যা তাদের সামাজিক কাঠামোতে নারীদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা এবং ক্ষমতা প্রদান করে। এই প্রথা নারীদের স্বতন্ত্র এবং ক্ষমতাশালী করে তোলে এবং সমাজে নারীদের মর্যাদা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে।

মাতৃতান্ত্রিক উপজাতি সমাজ ব্যবস্থা একটি ব্যতিক্রমী এবং আকর্ষণীয় প্রথা যা সমাজে নারীদের বিশেষ মর্যাদা এবং ক্ষমতা প্রদান করে। মিনাঙ্কাবাও, মোসো এবং গারো সমাজগুলি এই ধরনের প্রথার চমৎকার উদাহরণ। যদিও এই সমাজগুলি অনেক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি, তবুও তাদের স্বতন্ত্র সংস্কৃতি এবং প্রথা আমাদের সমাজে নারীদের গুরুত্ব এবং ক্ষমতার উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।

মিনাঙ্কাবাও (ইন্দোনেশিয়া)

মিনাঙ্কাবাও হল ইন্দোনেশিয়ার পশ্চিম সুমাত্রায় বসবাসকারী একটি মাতৃতান্ত্রিক সমাজ। এখানে সম্পত্তি এবং সামাজিক মর্যাদা মায়ের লাইন দ্বারা উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত হয়। মহিলারা পরিবারের প্রধান এবং সম্পত্তির মূল কর্তৃত্ব তাদের হাতে থাকে। মিনাঙ্কাবাও সমাজে নারীদের বিশেষ মর্যাদা এবং ক্ষমতা রয়েছে যা সমাজের বিভিন্ন দিক প্রভাবিত করে।

মোসো (চীন)

চীনের ইউনান এবং সিচুয়ান প্রদেশের মোসো উপজাতি একটি প্রসিদ্ধ মাতৃতান্ত্রিক সমাজ। এখানে নারীরা পরিবারের প্রধান এবং উত্তরাধিকারী হয়। মোসো সমাজে বিবাহ প্রথা আলাদা, যেখানে নারীরা পুরুষদের চেয়ে বেশী স্বাধীন। সম্পর্কের ক্ষেত্রে নারীদের অধিকাংশ সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা থাকে এবং বিবাহ বিচ্ছেদ সহজ।

গারো (ভারত)

ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বাসকারী গারো উপজাতি একটি মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা অনুসরণ করে। এখানে মহিলারা পরিবারের প্রধান এবং সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয়। গারো সমাজে নারীদের বিশেষ মর্যাদা এবং ক্ষমতা রয়েছে যা তাদের সমাজের বিভিন্ন দিক প্রভাবিত করে।


Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url